ঔপনিষদিক – ১
ওঁ।
তিনি অনির্বচনীয়, অচিন্ত্য।
তাঁর রূপ, মহিমা ও গুণের বর্ণনা ভাষার সাধ্যাতীত। তাঁর আকার, আকৃতি, লিঙ্গ ইত্যাদি নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। আর্যভাষা বাংলার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিভিন্ন বিভক্তিভেদে এই ভাষার প্রথম পুরুষ সর্বনাম পদের (তিনি/তাঁকে/তাঁর) প্রয়োগে তাঁকে নির্দেশ করা চলে এবং যেহেতু বাংলাভাষায় স্ত্রী অথবা পুংলিঙ্গভেদে এইসব সর্বনাম পদের রূপের কোনো পরিবর্তন হয় না, সেই কারণে তাঁর ধারণার সঙ্গে ভাষারও একটা সঙ্গতি রক্ষা করা সম্ভব হয়।
তিনি কারণ, কর্তা, কার্য – এই ত্রিবিধ হয়েও অকর্তা। তিনি গুপ্ত; বাক্, মন এবং চক্ষুর অগোচর। চাইলে তিনি আপনি ধরা দেন; অনিন্দ্যসুন্দর কান্তি ধারণ ক’রে অবতীর্ণ হন ধরায়; মানুষের মাঝে বিচরণ করেন, মানুষের ভাষায় কথা কন, এবং আশ্চর্য সব কীর্তি স্থাপন ক’রে সবার অলক্ষ্যে পুনরায় যবনিকার অন্তরালে চ’লে যান।
তিনি একাধারে নট, নাটক এবং নাট্যকার – জগতরূপী মঞ্চের ‘পরে সংঘটিত সকল ঘটনার তিনিই সূত্রধার, অথচ তিনি নির্বিকার, বৈরাগী। তিনি বিশ্বচরাচরকে আচ্ছন্ন ক’রে আছেন১, আবার সেই বিশ্বজগতের মধ্যে তিনি থেকেও নেই। তিনি অনন্ত, তাই তাঁকে সীমিত করা যায় না – তাঁকে ধরতে গেলেই তিনি হারিয়ে যান। একমাত্র প্রেমই পারে তাঁকে বাঁধতে, চিদ্ঘন রূপ দিতে।
ব্যষ্টিতে তিনি নিজেকে অংশতঃ ব্যক্ত করেন, সমষ্টিতে তিনি ভূমা। অথচ এই সমষ্টিও তাঁর স্বরূপ নয়, বরং তাঁর গাত্রের আবরণতুল্য – তাঁর নিজেরই হাতে গড়া স্বর্ণ-হীরকখচিত অলঙ্কার মাত্র। এসবের আড়ালে তিনি নিজেকে গোপন ক’রে রাখেন। তাঁকে জানবার জন্য আকুলহৃদয় মানুষ তাই মন্ত্রোচ্চারণে প্রার্থনা করে :
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।
(মন্ত্র ১৫, ঈশ উপনিষদ)
[বঙ্গানুবাদ –
সোনার জালে আবৃত আছে সত্যপথের দুয়ার,
তারে ছিঁড়ে ফেলে, হে পূষন্, তুমি নাশো এ মোহ আমার।]
ব্যক্ত অবস্থায় তিনি চির-স্পন্দমান। আলোকতরঙ্গ রূপে, উদয়-অস্ত রূপে, জোয়ার-ভাঁটার মধ্যে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস হয়ে, নাড়ির গতিতে হৃৎস্পন্দনে দিন-রাত্রি-ষড়ঋতুর আবহমান যাওয়া-আসায় – জন্মমরণের দোলায় তাঁর স্পন্দমানতার সততঃ প্রকাশ। কালের আবর্তনে, সুখ-দুঃখের যাতায়াতে, যুগচক্রের পরিবর্তনে তাঁর অবিরাম গতির স্বাক্ষর।
অথচ তিনি স্থাণু – সদা স্থির, ধ্রুব, অচঞ্চল। তিনি পুরাতন, সনাতন – তাঁরই অনুসন্ধানরূপী আমাদের এই ধর্মও তাই সনাতন নামে আখ্যাত। তিনি অজর, অমর, অশোক। আনন্দ তাঁর স্বভাব।২ তিনি আপনাতে আপনি নিমগ্ন, তাই তিনি জড় নন, বরং একেবারে বিপরীত – তিনি বিশুদ্ধ চৈতন্য, সদা সচেতন। আপন চিৎশক্তির দ্বারা তিনি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কার্য সাধন ক’রে থাকেন।
তিনি প্রেমময়। তিনি নির্নিমেষ নয়নপাতে প্রেমসুধাভরা দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে থাকেন। তিনি জানেন আমি তাঁর সঙ্গে মিলব, তাঁর মধ্যে বিলীন হব, সেই মিলনের মুহূর্ত অব্দি অনিমেষ চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকেন। তাঁর সে দৃষ্টিতে যেন প্রেম বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, কবির রচনা স্বতঃই রচিত হয়, তাঁর সে দৃষ্টি আমায় কল্যাণের পথে, ধর্মপথে, সত্যপথে রাখে – ক্ষণেকের তরেও সে পথ থেকে চ্যুত হলেই তাঁর দৃষ্টির কথা মনে প্রবল অনুশোচনা জাগিয়ে তোলে। তিনি নিরাসক্ত নিরপেক্ষভাবে অপেক্ষা ক’রে থাকেন; কখন আমি – তাঁর ভক্ত, তাঁর দাস, তাঁর সন্তান – তাঁরই মতো আপনাতে আপনি মগ্ন হব, চিচ্ছক্তিকে সম্পূর্ণ করায়ত্ত সংহত ক’রে আপন সত্যস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হব, শুদ্ধচৈতন্য আনন্দস্বভাব হব – তারই অপেক্ষায় তিনি, প্রেমের ঠাকুর, যেন চির অপেক্ষারত। সুখে তিনি প্রশ্রয় দেন, দুঃখে শুশ্রূষা জোগান।
যেহেতু তিনি স্বয়ং আনন্দস্বরূপ, তাই ভক্তের সঙ্গে তাঁর স্বাভাবিক মিলনক্ষেত্র হ’ল আনন্দস্বভাব বৈরাগী ভক্তের চিত্তভূমি। তিনি নিজে বিশুদ্ধ চৈতন্য, সেইজন্য শুদ্ধসত্ত্ব সাধকের কাছেই তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধরা দেন। সে মিলনের আস্বাদ অমৃতের আস্বাদ, সেই ধরা দেওয়া সকল বন্ধনের মোচন, সেই প্রকাশই জীবের মুক্তি। সে হ’ল চিরকালের মতো সকল আবরণের উন্মোচন, সে হচ্ছে অন্ধকার কালকুঠুরিতে শতসূর্যের একত্র উদয়। তাই উপনিষদের ঋষি তাঁর সঙ্গে মিলনের কথা স্মরণ ক’রে এইপ্রকারে ভাষায় ব্যক্ত করেছেন :
আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।৩
[অর্থাৎ, যিনি আনন্দরূপে প্রকাশ পান; যিনি অমৃত, নিত্য।]
তিনি এক এবং অদ্বিতীয় (একমেবাদ্বিতীয়ম্)। তিনি শান্ত, অনন্ত মঙ্গলময়, অদ্বৈত (শান্তং শিবমদ্বৈতং)৪। আবার সেই তিনিই বহু হয়েছেন : একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি – যে এক সত্যকে ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিগণ বহুপ্রকারে বর্ণনা ক’রে থাকেন।]
তিনি জন্মরহিত, অনাদি, নাম-লিঙ্গরহিত। তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছেন যে সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা, তাঁরা তাঁর অনন্ত গুণরাশির মধ্যে থেকে কিছু কিছু অংশ চয়ন ক’রে তাঁকে নামে-রূপে বেঁধেছেন, যাতে আংশিকভাবে হ’লেও সাধারণে তাঁর কিছুমাত্র ধারণা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ব্রহ্মের সেই সাকার অংশ-ধারণা থেকে নিরাকার ব্রহ্মের পূর্ণ-ধারনায় উত্তরণের জন্য যে প্রয়াসের প্রয়োজন হয়, তা একান্তই মানুষের নিজস্ব প্রয়াস। এই প্রয়াস সুকঠিন, এবং এই দুর্গম পথে মানুষ একেবারে একা। ঋষিগণ, শাস্ত্র, এমনকী স্বয়ং গুরুও তার হয়ে এই পথে পাড়ি দিতে পারবেন না – সে পথে তাকে একাই অগ্রসর হ’তে হবে।
তাঁর অংশবিশেষ ধারণা ক’রে খণ্ডে খণ্ডে তাঁকে দেখতে পাই ব’লে তাঁর নাম ও রূপের এতরকম বৈচিত্র্য। কখনো তিনি উগ্র, রুদ্র; আবার কখনো বা স্নিগ্ধ, প্রসন্নবদন নারায়ণ; কখনো সংহারোদ্যতা রণোন্মত্তা চণ্ডী; তো কখনো আবার লোকপালক সর্বকার্যের সিদ্ধিদাতা গণপতি। সঙ্গীতের সপ্তস্বরের মধ্যে তিনি ষড়জ; তালের কালবিভাগের মধ্যে সম; বর্ণমালার মধ্যে অ-কার; তথা শব্দরাজির মধ্যে তিনি আদি, অনাহত নাদ প্রণব।
তিনি ত্রিগুণাতীত, দেশকালের সীমাবদ্ধ গণ্ডীর অতীত – কারণ তিনিই দেশ তথা কালের উৎস ও নিয়ন্তা।
এই হ’ল দ্বৈততত্ত্ব।
পাদটীকা
১ ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। (মন্ত্র ১, ঈশ উপনিষদ)
২ আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। (ষষ্ঠ অনুবাক, তৈত্তিরীয় উপনিষদ)
৩ যঃ সর্বজ্ঞ…আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি। (মন্ত্র ৭, মুণ্ডক উপনিষদ, দ্বিতীয় মুণ্ডক, দ্বিতীয় অধ্যায়)
৪ নান্তপ্রজ্ঞং…স আত্মা স বিজ্ঞেয়ঃ। (মন্ত্র ৭, মান্ডূক্য উপনিষদ)
Featured Image: Kevin Habits